স্বাধীনতার বয়স এখন ৪৭ বছর। বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের ওপরে। এই ৪৭ বছরে আমাদের কত অর্জন, কতো ব্যর্থতা দৃশ্যমান। এই সব অর্জনে আমরা যেমন মাথা উঁচু করে বুক ফাটিয়ে স্লোগান দেই, খুশিতে আত্মহারা হই, ঠিক ব্যর্থতা দেখলে আমাদের শুধু মন খারাপই হয় না আজ, আমাদের শক্তি আর সাহস দুটোই হারিয়ে ফেলি ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের মতো। আজ আমাদের সবকিছুর মাঝে বঙ্গবন্ধু থাকলে কতই না সুন্দর হতো। তখন হয়তো আমরা এতটা বিভক্ত হতাম না। আমাদের এত দাবি থাকতো না আজ। এই বাংলাদেশ হয়তো বিশ্বের নেতৃত্বশীল দেশগুলোর একটি হতো। আমরা হতাম বিশ্বায়নের বিশ্ব।
নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে কালো অধ্যায়। এটা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তিনি যেমন ভাবতে পারেননি, তেমনি বাংলার নিষ্পাপ মাটিতে বঙ্গবন্ধুর রক্তেভেজা নিথর দেহটি দেখে আমরা বাকরুদ্ধ হয়েছি। আজও সেই দৃশ্য যখনই আমরা দেখি, মনের অজান্তেই আমরা অভিশাপ দেই নিজেদের। এতটা বর্বরতা কিভাবে সম্ভব কোন মানুষের পক্ষে? স্বাধীনতার পর মাত্র ৪ বছরের মাথায় বাংলার মাটি রক্তে লাল হয়েছে শেখ মুজিবের রক্তে। ত্রিশলক্ষ্য শহীদ আর দুলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের ক্ষত শুকাতে না শুকাতে মুক্তিযুদ্ধের মহা নায়ককে হত্যা করা হলো। সেদিন আমরা হারিয়েছি রাজপথের মহানায়ককে। আমরা হারিয়েছি স্বাধীনতার কাণ্ডারিকে। আমরা হয়ে গেছি এতিম। তবুও আজ আমাদের যত অর্জন আর যত ব্যর্থতা সবই ঘিরে আছে একটি নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। আজ যেন বাংলাদেশেরই অপর নাম ‘বঙ্গবন্ধু’।
ঘাতকেরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে মারলেই বাংলা হয়ে যাবে ঘাতকদের রাজত্ব। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার মানুষের জন্যে দ্বিতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা। যে নামে কবি কবিতা লিখতো আর মাঝি গলা ছেড়ে মাঝ দরিয়ায় সুর তুলতো মিষ্টি কণ্ঠে…‘তুমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একাত্তরে জন্ম নেওয়া বাঙ্গালীর আরেক না…’।
৭৫ এর ১৫ আগষ্টের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলার মাটি থেকে বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মরণ ঘটেছে সত্য, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন বাংলার মুক্তিপাগল গণমানুষের হৃদয়ে। যেভাবে শিশুর পিতা ঘুমিয়ে থাকে সব শিশুর অন্তরেভ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। সেজন্যে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালে শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী সন্তান ও আমাদের কাছে সম্মানিত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের জন্যে পাকিস্থান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ৭ ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণই ছিল মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মূলমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসে আজ সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙ্গালীর স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু আজীবনই আমাদের কাছে প্রিয় নেতা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাবের আগে বাঙালির প্রিয় নেতা ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন ব্রিটিশদের বলয়ে থেকে। তিনি ব্রিটিশ ভারতের পরাধীন মানুষকেও সে স্বপ্ন পূরণে রক্ত দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, নেতাজি তাঁর জীবদ্দশায় নিজ দেশকে স্বাধীন দেখে যেতে পারেননি। আমাদের বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের বলয়ে থেকে বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আমাদের বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের অধিকারের জন্যে, স্বাধীনতার জন্যে বঙ্গবন্ধুর মতো কাজ করে গেছেন অনেকেই। তবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একেবারেই আলাদা। বিশেষ করে আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধু জীবর আর মরণের মতো ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করছি আমি। তাঁরা দুজনেই জীবনের দীর্ঘ সময় কারান্তরালে কাটিয়েছেন, নিগ্রহের মুখোমুখি হয়ে আপসের কথা ভাবেননি। বঙ্গবন্ধু আর ম্যান্ডেলার মধ্যে মিল হলো যে স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন—মুক্ত, স্বাধীন স্বদেশ—নিজের জীবদ্দশাতেই তার বাস্তবায়ন দেখে গেছেন।
যে সময় বঙ্গবন্ধু তরুণ এবং দীপ্ত কৈশর, তখন নেতাজি কলকাতার মেয়র ও কংগ্রেসের নেতা। পৃথিবীর তিনপ্রান্তে সংগ্রামী তিনমুখ বঙ্গবন্ধু, নেতাজি সুভাষ বসু এবং ম্যান্ডেলা কেউ কারো সঙ্গে কখনো মুখোমুখি বসার সুযোগ আসেনি, কিন্তু তিন নেতা এক অদৃশ্য সুতোয় একে অপরের সঙ্গে বাঁধা ছিলেন। তাঁরা তিনজনই পরাধীন জাতির মুক্তির সফল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। শুধু নিজ নিজ দেশ বা জাতির নয়, পৃথিবীর যেখানেই নিপীড়িত মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, এই তিন নেতা তাঁদের জন্য আশার প্রতীক হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের অভিন্ন উদ্দেশ্য মানুষকে অত্যাচার, অন্যায় এবং গণতন্ত্রের মুক্তি দিয়েছে। তাঁরা তিনজনই নিজের উদাহরণে ব্যক্তি আমি থেকে আমরা হয়ে ওঠতে পেরেছেন।
গণমানুষের জন্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির হাতেখড়ি ১৬ বছর বয়সে। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গ নিয়ে মানুষের সাথে মেশা শুরু করেন যে বঙ্গবন্ধু সেই বঙ্গবন্ধুই এক সময় হয়ে ওঠেন বাঙ্গালীর পরিচয়। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি পড়তে গিয়ে কারাবরণের বিভিন্ন স্মৃতিতে অশ্রু টলমল করেছে আমার। আমি মনে করি এটা সবার পড়া উচিত। তাহলে আমাদের মনের অন্ধকার দূর হবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে।
বেশি দূর পড়া যায় না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে বর্ণমালা গুলোর উচ্চারণে।
বঙ্গবন্ধু ১৬ বছর বয়সে যে স্বদেশ প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, ২০১৮ সালে এদেশের তরুণ প্রজন্ম তেমনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। গতকাল ১৩ আগষ্ট কুর্মিটোলায় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, বাচ্চারা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাচ্চাদের আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন ইতিবাচক মন্তব্যকে আমি অভিনন্দন জানাই।
রাজনীতিতে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে আদর্শ অনেক বড়, এই চেতনা বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন নিজের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। ম্যান্ডেলাও তাই করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী অান্দোলনে কারাবরণকারী ম্যান্ডেলাকে সরকার বারবার প্রস্তাব দিয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধিতা ত্যাগ করলে মুক্তি পাবে। কিন্তু ম্যান্ডেলা রাজি হননি। সর্বশেষ ১৯৮৫ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রীর চিঠির প্রস্তাবও ম্যান্ডেলা জেল থেকেই দিলেন এভাবেই—‘নিজের মুক্তি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার জনগণের মুক্তি। আমি আমার জন্ম-অধিকার বিক্রি করতে পারি না, যেমন বিক্রি করতে পারি না আমার মানুষের মুক্ত হওয়ার অধিকার। আমি জেলে আসার পর অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। সেসব সন্তানহীন বাবা-মা, স্বামীহারা বধূ ও বাবাহারা সন্তানদের প্রতি আমার ঋণ ভুলে এই মুক্তি আমি চাই না।’
বঙ্গবন্ধুকেও ক্ষমতার লোভ দেখানো হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীত্ব হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন গণমানুষের কথা ভেবে। আমাদের স্বাধীনতার কথা ভেবে। আমাদের মুক্তির জন্যে জড়ো করেছেন। সংগ্রামী করে তুলেছেন। স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। আজ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা আছে কিন্তু বঙ্গবন্ধু নেই। আজ আমাকে লিখতে হচ্ছে তিনি ছিলেন। খুবই দু:খ হয় ছিলেন লিখতে কিন্তু নির্মম সত্যটা আজ সবাইকেই লিখতে হচ্ছে, লিখছিও তাই।
নেতাজি, বঙ্গবন্ধু অথবা ম্যান্ডেলা—কেউই এখন আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু ইতিহাসে আজও জীবন্ত তাঁদের কর্ম আর ত্যাগ। কীভাবে তাঁদের মনে রাখব, তার দায়ভার তাঁদের নয়, আমাদের। ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সবার স্মরণ করা উচিত শ্রদ্ধার সাথে। বঙ্গবন্ধু কোন দলের নয়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের। অন্তত বাঙ্গালী জাতি হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতেও বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা উচিত। যদি আমরা বঙ্গবন্ধুকে অহিংস আত্মায় সম্মান দিতে না পারি, তাহলে আজ বাংলাদেশ অসম্মানিত হবে। বাংলাদেশ ভাগ হতে পারে। বাংলাদেশে আবারো ১৫ আগষ্ট ঘটতে পারে। বাংলাদেশ পথ হারাতে পারে…।
লেখক : আরিফ চৌধুরী শুভ।।
Post a Comment