করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ঘরে থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল - রূপকল্প ২০৪১

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল

১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে কী অপরিসীম আত্মত্যাগ, অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ইতিহাস প্রোথিত আছে, তা বুঝা যায় কবির গানে আর কণ্ঠে-


দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা


কারো দানে পাওয়া নয়,


দাম দিয়েছি প্রাণ লক্ষ কোটি


জানা আছে জগৎময় ...।


এই স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেও শত শত বছর এদেশের মানুষ লড়াই-সংগ্রাম করেছে অত্যাচারী শোষকের বিরুদ্ধে। একাত্তরের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতকেও আমাদের জানতে হবে। দুশ' বছর শাসন করেছে ইংরেজ বেনীয়া গোষ্ঠী। তার পূর্বে আর্য সভ্যতা, গৌতম বুদ্ধ, জৈন, গ্রীক, মৌর্য, কুষান, গুপ্তসাম্রাজ্য, পালবংশ, সেনবংশ, সুলতানাতযুগ, মুঘল সাম্রাজ্যের পর বৃটিশ শাসনের সেই দুশ' বছরের গোলামীর জিঞ্জির থেকে বের হয়ে আসতে হলে সংগ্রাম আর আন্দোলন সৃষ্টি করেই আসতে হবে। তাই ভারত বর্ষের মাটি থেকে বৃটিশদেরকে তাড়াতে আরম্ভ হলো সংগ্রাম-আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার জন্য অনেক রক্ত ঝরেছে। দীপান্তর, ফাঁসি, জেল খেটেছে বহু নেতা-কর্মী। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, বিনয় বাদল দিনেশ, সিরাজউদ্দৌলা, তিতুমীর আরও অনেককে। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করা হয়। তখন পাকিস্তান, ভারত, বঙ্গদেশ নিয়ে একসঙ্গে ভারতবর্ষ। ব্রহ্মাদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। শাসন কর্তা সম্পূর্ণ ইংরেজ বেনীয়া গোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের সর্বশেষ ভারতবর্ষ শাসন করলেন মাউন্ট ব্যাটেন। তিনি এসেই দেখলেন হিন্দু-মুসলিম এ দুটি জাতির মধ্যে পরিপূর্ণ ব্যবধান রয়েছে। এ দু জাতির মধ্যে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করে তিনি এক পরিকল্পনার সুপারিশ করলেন, ভারত বিভাগ করলে ভালো হবে। এ পরিকল্পনা 'মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা' বা ৩রা জুন পরিকল্পনা নামে খ্যাত। এটি ভারতবর্ষের কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ সম্প্রদায় গ্রহণ করলো। কুখ্যাত মাউন্ট ব্যাটেন বিভেদের বীজ ঢুকিয়ে দিলেন। ইংরেজদের এই নকশা বহু পূর্ব থেকেই চলছিল এমন-১৯৪০ সালে লাহোরে এক বৈঠকে ভারতবর্ষের অঞ্চলগুলোতে মুসলমান বেশি সে রকম দুটি অঞ্চলকে নিয়ে দুটি দেশ এবং বাকি অঞ্চল নিয়ে একটি দেশ তৈরি হবে। কিন্তু দার্শনিকেরা মনে করেন, শুধু ধর্ম এক হলেই দুটো জাতি এক হয়ে রাষ্ট্র গঠন করতে পারে না। তা যদি হতো তাহলে ইরাক, আরব, মিশর এসব দেশ মিলে এক দেশ হলো না কেন? ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র তো খ্রিস্টান ধর্মের মানুষ। তারাতো একদেশ হয়ে যায়নি। পৃথিবীতে এমন বিচিত্র দেশের উদাহরণ আর নেই। তারপরেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আশা করেছিল, একবার অন্তত একটু শান্তি পাবো, পাকিস্তানের শাসকেরা ইংরেজদের মত শোষক, অত্যাচারী হবে না। জননেতা মহাত্মা করম চাঁদ গান্ধী ভারত ভাগ হবে তা তিনি চাননি। রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ করে কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী প্রমুখ মুসলিম রাষ্ট্র তৈরিতে সোচ্চার ছিলেন। এই ভুলের মাশুল তার দেশকে দিতে হয় ১৯৭১ সালে। আজ পাকিস্তানের একটি ডানা ভেঙ্গে গেছে। নিজ ভূমে আরো অধিক অশান্তি চলছে।


ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান এক পাকিস্তান, এক জাতি মুসলিম জাতি, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরি হলো। আর হিন্দু রাষ্ট্র ভারত। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে পথ চলতে থাকে। আর পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র, গণতন্ত্র অনুপস্থিত, ধর্ম নিরপেক্ষতা অনুপস্থিত। রাষ্ট্র চলছে যেনতেন ভাবে, অশান্তির বীজ দিন দিন দানা বাঁধছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম হলেও জাতি সত্তায় কিন্তু উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী। দুই পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সামাজিক, ভাষা, আচার, আচরণে দূরত্ব অনেক বেশি। সম্পদেও অনেক ব্যবধান। লোক সংখ্যায় দেখা যায় পাকিস্তানে দুই কোটি আর পূর্ব পাকিস্তানে চার কোটি। স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসা, বাণিজ্য, পুলিশ মিলিটারী সব কিছুতেই বেশি। পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাদের মাথায় পোকা ঢুকতে আরম্ভ করলো। তারা পূর্ব পাকিস্তানে শোষণের চিন্তা ভাবনায় প্রথমেই আঘাত করলো বাংলা ভাষার উপর। রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। বাঙালির বাংলা ভাষা মাতৃভাষা নয়।


১৯৪৮ সাল থেকে বাঙালি জনতা এর প্রতিবাদ করতে করতে চলে এলো ১৯৫২ সালে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনতা পূর্ব বাংলায় এক হয়ে এক দাবিতে মাঠে নেমে পড়লো। আন্দোলন, জেল খাটা, সংগ্রাম চলতে থাকে। ধীরেন দত্ত, একে ফজলুল হক, সোহরাওয়ারদী, মোজাফ্ফর, মনিসিং, শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানী, জিল্লুর রহমান প্রমুখ জাতীয় নেতৃত্বও রাজপথে নেমে পড়লেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই ভাষা সংগ্রামে প্রাণ বলিদান হলো রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত আরো অনেকের। সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানীদের উর্দুভাষী পুলিশ-মিলিটারীদের অত্যাচার নির্যাতন বেড়ে গেল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অশনি সংকেত দেখা দিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট তৈরি করলো পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা। জয়ী হলো যুক্তফ্রন্ট। আন্দোলন চলছে। ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে আইয়ুব খান এলেন সামরিক শাসক হিসেবে বন্দুকের নল বাঙালির বুকে ধরে। একদিকে সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার, অন্যদিকে অত্যাচার। সংগ্রামে বাঙালি জাতি ভয় পায় না। ১৯৬১, '৬২, '৬৯ বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন চলে। রাজনৈতিক অগ্রদূত সকলের গ্রহণযোগ্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এগিয়ে চলছেন। এই জাতিকে মুক্ত করতে হবেই। রাজনৈতিক নেতাদের ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা নিয়ে চলতে চলতে এক দফায় পরিণত হলো-নির্বাচন চাই। ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হলো। কিন্তু নির্বাচনের পর বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে চাচ্ছিলো না। টালবাহানা আরম্ভ হলো। এবার আবার সংগ্রামে মাঠে নামতে হলো। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বাংলার স্বাধীনতা ও সর্বভৌমত্বের চিন্তা চেতনায় বাংলাদেশের একটি হলুদ মানচিত্র খচিত সবুজ জমিন নিয়ে পতাকা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আ.স.ম. আব্দুর রব অপরাহ্নে পল্টন ময়দানে উত্তোলন করেন এবং সর্ব প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করেন জনাব শাহজাহান সিরাজ। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধু উপস্থিত বক্তব্য রাখেন। ২ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ঐতিহাসিক ছাত্রসভাতে এই পতাকা প্রথম উত্তোলন হয়। তা উত্তোলন করেন আ.স.ম. আব্দুর রব নিজেই। সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন ছাত্রদের পক্ষ থেকে। শেখ মুজিব পাকিস্তানী জান্তাদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন। কিন্তু তারা কিছুতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। কৌশলে বাঙালিকে হতা করে শ্মশানে পরিণত করতে রসদ ও সৈন্যবাহিনী রাতের অন্ধকারে নিয়ে আসতে থাকে। সোয়াত জাহাজে অস্ত্র গোলাবারুদ সৈন্যবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে ভীড়তে থাকে। মেজর জিয়া অস্ত্র খালাস কাজে তদারকিতে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগের এম.এন.এ. জনাব আবদুল মান্নানের কথায় চলে আসেন চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রে (কালুর ঘাট) এবং বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যাতে বাঙালি সৈন্য বাহিনী ও জনতা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমান আর ফিরে যাননি পাকিস্তানি জান্তাদের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের ১নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে চলে যান।


১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) ঐতিহাসিক এক ভাষণে ঘোষণা করেন-


'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম


এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'


মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে প্রস্তুতি নিতে থাকে। মানুষ নিধনযজ্ঞ আরম্ভ হয়ে গেল। পাক বাহিনীর সাথে যোগ দিল বিহারী, পাঞ্জাবী। বাঙালির ঘরে ঘরে আগুন, লুট, ধর্ষণ, হত্যা চলতে লাগলো। বাঙালি সেনারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিল। ২৫ মার্চ ৭১ পাকিস্তানী বাহিনী শুরু করলো ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। পাকিস্তানী বাহিনী কামান, ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর উপর। রাত গভীর হলে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা বেতারযন্ত্রে তারবার্তার মাধ্যমে প্রেরণ করেন। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সারাদেশে মানুষকে আলোড়িত করেছিল। সেই ২৬ মার্চের রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে জানা যায় তিনি পাকিস্তানে কারাগারে বন্দী। মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য উদিত হলো ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। একটি পতাকা একটি ভূখ- বাঙালি ফিরে পেল লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরিয়ে আনা হলো বাংলার মাটিতে ১৯৭২ সালের মিত্রবাহিনী ভারতের সহযোগিতায়।


স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে জনতা এগিয়ে চলতে থাকে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ৩২নং ধানমন্ডির বাড়িতে ১৫ আগস্ট একটি কুচক্রী মহল স্বাধীনতার বিপক্ষের কিছু কুলাঙ্গার হঠাৎ বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করলো। স্বাধীন দেশের চাকা ঘুরে যায়। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা দুই বোন বেঁচে যান বিদেশে লেখাপড়ায় থাকাতে। পরবর্তীতে চড়াই উৎরাই পার করে বাংলাদেশে এসে আওয়ামীলীগ পুনর্গঠন করে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌছে দিতে হবে, জনতার মুখে হাসি ফুটাতে হবে এই প্রত্যয়ে জনতাকে নিয়ে পিতৃহত্যার বিচার, জঙ্গিদমন, রাজাকার আলবদরসহ দেশীয় সকল দোসরকে দমন করতে সংগ্রামে নেমে পড়েন। এখনো কূটকৌশল চলছে। চলছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪৭ বছর। স্বাধীনতার লালসূর্য উদিত হবে ২৬ মার্চ প্রতিটি বছরের মতো। এবারের অঙ্গীকার হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা, জঙ্গি রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা, একটি স্বচ্ছ গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।





লেখক পরিচিতি : পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী

Related post you might see:

Share this product :

Post a Comment

 
Support : | RSTSBD | RSTSBD
Copyright © 2017. রূপকল্প ২০৪১ - All Rights Reserved
This Blog Published by RSTSBD
Created by Uno Badalgachi